শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৩

মন বাড়িয়ে ছুঁই



(১) ভার্সিটিতে যখন সবে পা দিয়েছি ---

সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি তূর্যর টেক্সট , ‘’সাড়ে সাতটার ট্রেনে আমাদের বগিতে চলে এসো’’ ।
তূর্য টেক্সট করেছে ! কি জানি , ঘুমভাঙ্গা চোখে হয়তো ভুলভাল দেখছি । চোখ ভালমত কচলে আরও দুবার পড়লাম ।নাহ্‌ ! ভুল দেখিনি ।তুর্যই ... । ছোট্ট একটা রিপ্লাই দিলাম , ঠিক আছে । খুব দ্রুত রেডি হয়ে সাতটার মধ্যেই পৌঁছে যাই স্টেশনে ।

তুর্য এখনো আসেনি । এত আগে ও আসেনা কখনো ।আমি চলে আসি ।কারো জন্য অপেক্ষা ব্যাপারটা নাকি খুব বিরক্তিকর কিন্তু কেন জানি ওর জন্য অপেক্ষা করতে আমার একটুও খারাপ লাগেনা ।

ট্রেন ছাড়ার ঠিক দুমিনিট আগে ও এসে পৌঁছোয় । আমার সামনের সীটে বসতে বসতে বলে ,
কি খবর বানরি ?
ওর চোখে তখন দুষ্টুমির হাসি । আমিও হেসে ফেলি ।
হুম , ভাল । আপনি ভাল তো ছাগল সাহেব ?
আর ভাল...একটা বানরিকে সামনে বসিয়ে কতটুকুই বা ভাল থাকা যায়, বল ?
ছাগল তো ... বানর আর মানুষের মাঝে পার্থক্য বুঝবেন কি করে ?

বছর দুয়েকের সিনিয়র তুর্যর সাথে আমার সম্পর্কটা এমনই । সারাক্ষণ একজন আরেকজনের পেছনে লেগে থাকা , কারনে অকারনে খোঁচানো আর দুষ্ট মিষ্টি ঝগড়া ।
ও প্রায়ই আমাকে প্রশ্ন করে ,
তুমি এত্ত ঝগড়াটে কেন ?
প্রশ্নটা শুনলেই আমার ভীষণ হাসি পায় ।তবু হাসি চেপে নতুন উদ্যমে ওর সাথে ঝগড়া শুরু করি ।
কি বললেন আপনি ? ঝগড়াটে ? ঝগড়ার কি দেখসেন এখনো ? ব্লা ব্লা ব্লা...

তূর্যকে কি করে বোঝাই আমার যত ঝগড়া সব ওর সাথেই... ! যতক্ষণ তূর্য আমার সামনে থাকে, আশেপাশের পৃথিবীটাকে আমি বেমালুম ভুলে যাই । আমার সমস্ত জুড়ে তখন শুধু তূর্য আর তূর্য । তূর্যর কয়েকটা ব্যাপার আমার ভীষণ ভাল লাগে । ও যখন আলতো ঠোঁট চেপে খুব হালকা হাসে আমি মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওকে দেখতে দেখতে নিঃশব্দে নির্মলেন্দুর কবিতা আওড়ে যাই ,
আমারো চাই বুকের মধ্যে এক্ষুনি চাই ধ্বনি,
যখনই আমি তোমাকে ভাবি,তক্ষুনি তা শুনি ।
সময় বসে ভেংচি কাটে,--এক্ষুনি নয় সব
আমিও বুঝি, তোমাকে পাওয়া একটু অসম্ভব ।

আর, ও যখন হাতের উল্টোপিঠে কপালের কাল্পনিক ঘাম মুছে হাত ঝাড়া দিয়ে খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বোঝাতে চায় ‘আমি ক্লান্ত ’ , আমার বড্ড হাসি পায় । ওর মিথ্যে সিরিয়াসনেস দেখে আমি খুব একচোট হেসে নিই ।
আমার খুব ইচ্ছে করে পুরোটা জীবন ওর সাথে এমন খুনসুটিতেই কাটিয়ে দিব । অকারনে ওকে রাগিয়ে দিব , ইচ্ছেমতোন ওর অপছন্দের কাজগুলো করব ।আমার কান্ডকীর্তন দেখে ও আমাকে খুব বকে দেবে , রেগেমেগে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকাবে আর আমি তখন , ঠিক তখনই ওর গোল্টু গোল্টু চোখগুলোর দিকে তাকিয়ে ফিক্‌ করে হেসে দিব । ভ্রু নাচিয়ে বলব ,
‘’ দেখলে মশাই , কেমন ধাপ্পা দিলাম ! রাগাতে পারবো না বলেছিলে না ! খুব তো রাগিয়ে দিলাম । ‘’
আমি ইচ্ছে করে ওকে রাগিয়ে দিয়েছি বুঝতে পেরে ও এগিয়ে এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে, ‘পঁচা মেয়ে একটা !’ বলতে বলতে জোরে কান মলে দেবে ।
আর আমি ? কান্নার ভান করে ওর বুকে মাথা রেখে , মুঠো পাকিয়ে ওর পেটের ঠিক মাঝখানটাতে বিশাল একটা ঘুষি বসিয়ে দৌড়ে পালাবো । পালিয়ে যাবার সময় মুখ বেঁকিয়ে ওকে ভেংচি কেটে বলব , ‘হুম! খুব পঁচা !’

(২) ভার্সিটি যখন শেষের পথে ---

এবারের গল্পটা একটু অন্যরকম ।তূর্য এখন বেশ বদলে গেছে । এখন আর আগের মত ঘর কাঁপিয়ে হাসে না । শেষ কবে ওর সাথে ঝগড়া করেছি , ওর বড়বড় চোখদুটোতে দুষ্টুমির খেলা দেখেছি আমার ঠিক মনে পড়েনা । তূর্য আজকাল খুব সিরিয়াস । আগে একটু আধটু জড়িত থাকলেও রাজনীতিতে ও এখন বেশ সক্রিয় । শুধু কি রাজনীতি করলেই চলে ? শুনেছি , নিয়মত নেশাও করে । তূর্যর সাথে দেখা হয়না অনেকদিন ।রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত খুব। আমিও আর ঘাঁটাইনা । ওকে যে দেখতে ইচ্ছে করেনা , তা না। কিন্তু অপূর্ণতার ভয়ে ইচ্ছেটাকে সযত্নে বিসর্জন দিই ।

এরই মাঝে হঠাত একদিন ঝুপড়িতে দেখি তূর্য বসে আছে ।উদ্ভট সব ছেলেদের মাঝে বসে সিগারেট ফুঁকছে আর ঢুলু ঢুলু চোখে চারপাশে তাকাচ্ছে ।ওর লাল হয়ে যাওয়া চোখের চাহনি দেখে আমার বুকের ভেতরটা হুহু করে ওঠে । গলা বেয়ে উঠে আসা কান্নাটাকে প্রাণপণে সামলে আমি তূর্যর সামনে গিয়ে দাঁড়াই । ।আমাকে দেখে বোধয় ও একটু অস্বস্তিতে পড়ে যায় ।ওর অস্বস্তি দেখে আমিই কথা বলি , একটু আসবেন আমার সাথে ?

কিছু না বলে চুপচাপ উঠে আসে । ওর বন্ধুদের থেকে কিছুটা তফাতে অন্য একটা বেঞ্চিতে বসি দুজন।
তুর্যর হাতে তখনও সিগারেট । আমি সন্তর্পণে ওর হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে ফেলে দিই ।ও নিস্পৃহ চোখে আমার দিকে একবার তাকায় । আমার ভেতরে তখন রাজ্যের ভাংচুর । আমি খুব ধীরে ধীরে ওর টেবিলেরাখা হাতদুটো আমার মুঠোয় পুরে ,টকটকে লাল চোখ দু্টোতে চোখ রেখে থেমে থমে বলি -
আপনি কি পারেন না আগের মত হয়ে যেতে ? একদম আগের মত ?
তূর্যর হাতদুটো আরও শক্ত করে চেপে ধরি ।আমার দু’গালে তখন জলের ধারা । ও ভাবলেশহীন । কান্নার দমকে আমি কেঁপে কেঁপে উঠি ।আমি বুঝতে পারি তূর্য খুব বিব্রত বোধ করছে । ও অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রাখে ।আমার মুঠো একটু আলগা হতেই তূর্য ওর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে নিঃশব্দে চলে যায় । আমি বসে থাকি একরাশ অভিমান নিয়ে । আমার কান্নারা ওকে ছুঁতে পারেনা । একটুও না ।
তারপর অনেক অনেকদিন তূর্যর আর কোন খোঁজ পাইনা । ফোন সুইচ্‌ড্‌ অফ্‌ , ক্যাম্পাসেও দেখিনা । হয়তো ক্যাম্পাসে আসে , আমারই চোখে পড়েনা ।স্টেশনে , ট্রেনে , ঝুপড়িতে , জিরো পয়েন্টে , ওর ফ্যাকাল্টিতে সবখানেই আনমনে খুঁজে বেড়াই । কোত্থাও ওর দেখা পাইনা । তবু মনে মনে স্বপ্ন বুনি , তূর্য একদিন ভাল হয়ে যাবে । সুস্থ জীবন যাপন করবে। বগি দাবিয়ে গাইবে , বন্ধুদের সাথে মজা করবে , প্রাণখুলে হাসবে আর আমাকে দেখলেই দুষ্টুমি ভরা চোখে বলবে , বানরি একটা !!
সৃষ্টিকর্তার কাছে সারাক্ষণ প্রার্থনা করি , তূর্য যেন ভাল হয়ে যায় । ও যেন আগের মত , ঠিক আগের তূর্যটা হয়ে যায় ।

(৩) ভার্সিটির গন্ডি পেরিয়ে ---

পড়াশোনার পাট চুকিয়ে চাকরিতে ঢুকেছি কয়েকমাস হল । সারাদিন অফিস শেষে বাসায় এসে আর কিচ্ছুটি করার এনার্জি থাকেনা । একসময় কিছু না করি , প্রতিদিন অন্তত একবার পেপারে চোখ বুলিয়ে নিতাম , ফেসবুকে বসে বন্ধুদের খোঁজ নিতাম । এখন সবকিছুই সপ্তাহান্তে ছুটির দিনটার জন্য তোলা থাকে । সারা সপ্তাহের জমানো পেপারগুলো শুক্রবার বসে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ি ।

একদিন পেপার পড়তে বসে একটা ছবিতে চোখ আটকে যায় । ঠিক সেই হাসি , সেই চাহনি । আমার চিনতে একটুও ভুল হয়না ।ছবিটা কিছুক্ষন উল্টেপাল্টে দেখার পর ওপরের শিরোনাম পড়ি ,
চবিতে ‘’ ...... ‘’ এর দুই গ্রুপের সংঘর্ষে একজন নিহত ।
তূর্য ?! অসম্ভব !আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে । খুব দ্রুত খবরটা পড়া শেষ করি ।
হুম ।তূর্যই ...
কদিন আগের পুরনো পেপারটা হাতে নিয়ে আমি একদম স্থির হয়ে যাই । পাথর যেন ।

(৪) অন্য পৃথিবীতে ---
তূর্য নেই । আমার জীবনের সবচেয়ে কঠিন সত্যটা মানতে কষ্ট হলেও ঠিক মেনে নিয়েছি । তূর্যহীন পৃথিবীটাতে আমি একদম ভাল নেই । ভীষণ ঘুমকাতুরে আমি আজকাল ঠিকমত ঘুমাতে পারিনা । ঘুমে চোখ বুজে আসতেই তূর্যর গলা শুনতে পাই ,
এই বানরি , তুমি তো আমাকে ভালবাসতে । বলনি কেন , হুমম ?
- আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করি , আপনি জানতেন ?
তূর্য হো হো করে হেসে ওঠে ।
- নিজেকে খুব চালাক ভাবো ,তাই না ?
- উঁহু । চালাক না , বুদ্ধিমতী ।
- বুদ্ধিমতী না ছাই ! আমি হাসলে অমন করে তাকিয়ে থাকতে কেন ? জানোনা , মেয়েদের ওভাবে তাকাতে নেই ?
- জানি তবে মানিনা ।
- ফাজিল একটা ! মানবে না কেন ?
- জানেনই তো কেন ...
- উঁহু , জানিনা । তোমার মুখে শুনব ।

আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । এবারও আমি বলতে পারিনা , ভালবাসি । তাতে কি ? ঘুম ভাঙতেই শুরু করি চিরকুটে কাটাকুটি । সবগুলোতেই একই লেখা। ভালবাসি... ভালবাসি...

বাসার সবাই এসে দেখে যায় আমার রুমভর্তি কাগজের ছড়াছড়ি । প্রতিদিনই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি । প্রথমদিন মা এসে খুব বকে যায় । এখন আর কিছু বলেনা । মাঝেমাঝে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে । আশপাশের মানুষজন নাকি বলাবলি করছে, আমি পাগল হয়ে গেছি । আমার হাসি পায় , চিরকুটে ভালবাসি লিখলে কি কেউ পাগল হয় ? ওরা খুব বোকা । কিচ্ছু বোঝেনা ।

আচ্ছা , আমার একটা চিরকুটও কি তূর্যের কাছে পৌঁছায় না ? ও কেন প্রতিদিনই বলে , তোমার মুখেই শুনবো ?

তূর্য কখনো কবিতা ভালবাসত না । কিন্ত কাল রাতে আমাকে খুব অবাক করে দিয়ে ও কবিতা শোনার বায়না ধরল ।
- তুমি না খুব কবিতা ভালোবাসো ? আমাকে শোনাবে ?
- কবিতা শুনবেন ? আপনি ? অবাক করলেন ।
- তাই ?
- জ্বি , তাই ।
- হয়েছে । তোমাকে অবাক করতে পেরে আমি ধন্য । এবার কবিতা শোনাও ।

আবৃত্তির ‘আ’ না জানা আমি মাঝরাত্তিরে গভীর আবেগে আমার সবচে’ প্রিয় কবিতাটা ওকে শোনাই ,

হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুই-কে আমি এক করিনা,
এক-কে করি দুই ।

হেমের মাঝে শুই না যবে
প্রেমের মাঝে শুই ।
তুই কেমন করে যাবি ?
পা বাড়ালে পায়ের ছায়া,
আমাকে তুই পাবি।

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই ।

তখন আমি একটু ছোঁব
হাত বাড়িয়ে জড়াবো তোর
বিদায় দু’টি পায়ে - ।
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে ।

নায়ের মাঝে বসবো বটে
‘না’-এর মাঝে শোব ;
হাত দিয়ে তো ছোঁবনা মুখ
দুঃখ দিয়ে ছোঁব ।

তুই কেমন করে যাবি ?

( গল্পে ব্যবহৃত কবিতা দুটোই নির্মলেন্দু গুণ এর লেখা । প্রথমটি ‘’তবুও তোমাকে চাই’’ এর অংশবিশেষ , দ্বিতীয়টি ‘’ যাত্রাভঙ্গ ‘’ )

....................................anindita.................................................................
srabon.....................

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

srabon204